বিস্তারিত

রাসুল প্রেম কি ও কেন?

মাওলানা মুফতী আব্দুল আহাদ 08 ডিসেম্বর



 রাসুল প্রেম তথা রাসুল (স.) কে মুহাব্বত করা ও তাঁর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও ঈমানের দাবি। কেননা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” ইসলামের এই কালিমায় দুটি বিষয়  রয়েছে (ক)আল্লাহর তাওহীদ (খ) নবীজির রিসালাত। আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমানের দাবী হচ্ছে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি মুহাব্বত পোষণ করা। এটাও ঈমানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। আবার আল্লাহর প্রতি মুহাব্বত প্রকাশের পন্থাও রাসুল (স.) এর অনুসরণের মাধ্যমে হতে হবে। স্বয়ং আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, অর্থ, ‘(হে নবী) বলুন, যদি তোমরা  আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তাহলে আমার অনুসরণ কর’। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৩১) তাই নবীপ্রেম ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও ঈমানের দাবি। 
       উম্মতের প্রতি রাসুল (স.) এর প্রেম, ভালবাসা ও দরদ এত বেশী ছিল যে, উম্মতের চিন্তায় নিজের সব সুখ-দুঃখের কথা ভুলে গিয়েছিলেন বিসর্জন দিয়েছিলেন সব চাওয়া-পাওয়া ও সুখ-শান্তিকে। এজন্য তিনি আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে ছিলেন, হারাম করে ছিলেন আরামের নিদ্রাকেও। 
       শুধু তাই নয়, আমদের প্রিয় নবী (সা.) তাঁর সারা জীবনের কষ্ট, মেহনত ও মুজাহাদার মাধ্যমে, বদন মোবারক রক্তে রঞ্জিত ও দান্দান মোবারক শহীদ করার মাধ্যমে আমাদের নিকট মুক্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলাম পৌঁছে দিয়ে আমাদের প্রতি অনেক বড় ইহসান করেছেন। যে ইহসানের বদৌলতে আজ আমরা মুসলমান হতে পেরেছি। 
      আমাদের প্রতি রাসুল (স.) এর এই ইহসান ও ভালবাসার কোন বদলা হতে পারেনা এবং আমাদের জীবন দিয়েও এই ভালবাসার বদলা আদায় করতে পারবোনা। তার পরও মানুষ যদি বিশ্বাস করে ও চিন্তা করে যে, রাসুল(স.) আমার জন্য সব কিছু বিসর্জন দিয়েছেন, তাহলে সেও রাসুল (স.) এর জন্য সব কিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। রাসুল (সা.) এর প্রতি বিশ্বাসী মু’মিনের মধ্যে এই অবস্থার সৃষ্টি হতেই হবে। যদি এই অবস্থার সৃষ্টি না হয় তাহলে বুঝা যাবে রাসুল (সা.) এর প্রতি তার বিশ্বাস ও ঈমনের মধ্যে ত্রুটি  রযেছে। কেননা হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, অর্থ, ‘তোমরা কেউ পরিপূর্ণ মু’মিন হতে পারবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদের নিকট বেশি প্রিয় না হবো, তার পিতা-মাতা, সন্তানাদি থেকে, এমনকি সমস্ত মানুষ থেকে’। (মুসলিম) 
      একবার হযরত ওমর (রা.) বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি আপনাকে ভালবাসি। রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার জীবনের চেয়েও কি বেশী? হযরত ওমর (রা.) কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, না আমার জীবনের চেয়ে বেশী নয়। রাসুল (সা.) বললেন, না ওমর তাহলে হয়নী, এখনও ভালবাসা হয়নী। হযরত ওমর আবার চিন্তা করে মনকে প্রস্তুত করে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি আমার জীবনের চেয়েও আপনাকে বেশী ভালোবাসি। রাসুল (সা.) বললেন , ওমর, এতক্ষণে হয়েছে। বোঝা গেল পুর্ণাঙ্গ মু’মিন হতে চাইলে এবং রাসুল (সা.)কে ভালোবাসার দাবীতে সত্যবাদী হতে চাইলে নিজের আপনজন, স্ত্রী-পুত্র, ধন-সম্পদ, ঘর- বাড়ী এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও রাসুল (সা.) এর প্রতি ভলোবাসা বেশী হতে হবে। আল্লাহ তায়ালঅ ইরশাদ করেন: হে মুহাম্মাদ, আপনি লোকদের বলে দিন, যদি তোমাদের পিতা - মাতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই - বোন, তোমাদের স্ত্রীগন, তোমাদের ধন - সম্পদ যা অনেক কষ্ট করে উপার্জন করেছ, তোমাদের ব্যবসা-বানিজ্য যার লোকসানের ভয় পাও, তোমাদের ঘর - বাড়ী যাকে তোমরা খুব পছন্দ কর - এই সব কিছুর চেয়ে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের প্রতি ভালবাসার মাত্রা বেশী না হয়, তাহলে তোমরা শাস্তির নির্দেশের অপেক্ষা কর। (সুরা তাওবা; ২৪)  এই আয়াতের মর্ম অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরাম আমল করে দেখিয়েছেন এবং সব কিছু থেকে রাসুল (সা.) কে বেশী ভালোবেসে পুর্ণাঙ্গ মু’মিনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। 
         হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাবুকের যুদ্ধে সমস্ত মাল এনে দিয়েছেন, ঘরে একটি কানাকড়িও রাখেননি। রাসুল (স.) এর জন্য সব কিছু উজাড় করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে রাসুল (স.) বলেন, অর্থ, কারও সম্পদ আমার এত কাজে আসেনি আবু বকারের সম্পদ যত কাজে এসেছে, (ইবনে মাজাহ)। 
আবু বকর (রা.) প্রমান করেছেন নিজের সম্পদের চেয়ে তিনি রাসুল (সা.) কে বেশী ভালবেসেছেন। 
         উহুদের ময়দানে রাসুল (স.) শহীদ হয়ে গেছেন মর্মে সংবাদ শুনে একজন মহিলা মদিনা হতে তিন মাইল দুরে উহুদের ময়দানের দিকে দৌড়াচ্ছে আর জিজ্ঞাসা করছে রাসুল (সা.) এর অবস্থা কি ? এক জন তাকে বললো, তোমার ছেলে ও তোমার স্বামী শহীদ হয়ে গেছেন, এতেও তার কোন পরওয়া নাই, শুধু ছুটছে আর বলছে তোমরা আমাকে বল রাসুল (স.) কেমন আছেন? এই মহিলা সাহাবী প্রমান করে দিয়েছেন তার পুত্র ও স্বামীর চেয়ে তিনি রাসুল (সা.) কে বেশী ভালোবাসতেন। 
          হযরত যায়েদ ইবনে দাছিনা (রা.) কে মক্কার মুশরিকরা বন্দি করে নিয়ে তার সামনে প্রস্তাব রাখলো যে, এখন তোমাকে হত্যা করা হবে। তবে যদি তুমি স্বীকার কর যে, তোমার স্থানে ‘মুহাম্মাদ’ কে হত্যা করা হবে তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন! আমার স্থলে আমার রাসুল (সা.) কে শহীদ করা হবে এটাতো অনেক বড় কথা আমি মুক্তি পেয়ে যাবো, আর রাসুল (সা.) এর পায়ে একটা সামান্য কাঁটা বিধবে আমি তাও বরদাশত করতে পারবোনা। তিনি প্রমান করলেন যে, নিজের জীবনের চেয়ে তিনি রাসুল (সা.) কে বেশী ভালোবাসতেন। এই ভাবে সাহাবায়ে কেরাম প্রমান করেছেন  যে তারা পুর্ণাঙ্গ মু’মিন ছিলেন। তারা সব কিছুর চেয়ে রাসুল (স.) কে বেশী ভালোবাসতেন।
              সাহাবায়ে কেরামের সামনে রাসুল (সা.) স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন, জীবিত ছিলেন। তাই তারা রাসুল (সা.) কে ঐ ভাবে ভালোবাসতে পেরেছেন। এখন রাসুল (স.) আমাদের সামনে স্বশরীরে উপস্থিত নেই, তার অবর্তমানে আমরা তাঁকে কি ভাবে ভালোবাসবো সেটাও আল্লাহ পাক কোরআনুল কারিমে ও রাসুল (সা.) বহু হাদীসে বলে দিয়েছেন। আল্লাহ পাকের ইরশাদ: “তোমাদের রাসূল তোমাদের যা কিছু আদেশ করেন তা তোমরা পালন কর আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক”, (সুরা হাশর, আয়াত;৭)। 
       হাদীসের আালোকে রাসুল (সা.) এর অবর্তমানে  তাঁকে ভালোবাসার ১নং তরীকা হলো, তাঁর সুন্নাত- আদর্শ বা তাঁর তরীকাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসা। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে আমার সুন্নাতকে ভালোবাসল সে আমাকে ভালোবাসল’ (তিরমিযী )। 
অতএব, রাসুল (স.) এর সুন্নাত বা আদর্শকে যদি আমরা আমাদের জীবনের চেয়ে বেশী ভালোবাসতে পারি, তাহলেই বুঝা যাবে রাসুল (স.) এর প্রতি আমাদের যথার্থ ভালোবাসা আছে। 
               রাসুল (স.) কে ভালোবাসার ২নং তরীকা হলো, রাসুল (স.) এর প্রতি বেশী বেশী দরুদ ও ছালাম পাঠ করা । যা অনেক বড় মর্যাদা সম্পন্ন ও অতি সহজ আমল। হাদীস শরীফে এসেছে, কিয়ামতের দিন আমার সবছেয়ে বেশী নিকটবর্তী হবে ঐ ব্যক্তি যে দুনিয়াতে আমার উপর সবচেয়ে বেশী দরুদ পাঠ করেছে। (তিরমিযী) 
          রাসুল (স.) কে ভালোবাসার ৩নং তরীকা হলো, রাসুল (স.) এর সাথে যাদের ভালোবাসা ছিল তাদের কে ভালোবাসা। তাই রাসুল (স.) কে ভালোবাসলে তাঁর আহলে বাইত ও প্রিয় সাহাবীদেরকে ভালোবাসতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘আমার সাহাবীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহ কে ভয় কর। আমার সাহাবীদেরকে তোমরা সমালোচনার পাত্র বানাবেনা। যে আমার সাহাবীদের ভালোবাসল সে আমাকে ভালোবাসল আর যে আমার সাহাবীদের প্রতি বিদ্বেষ রাখল সে আমার প্রতি বিদ্বেষ রাখল’। (তিরমিযী) 
        এই হল রাসুল (স.) কে ভালবাসার তরীকা। এই তরীকা যারা অনুসরণ করবে, তারাই প্রকৃত আশেক বা প্রকৃত রাসুল প্রেমিক। এই গুলো ছাড়া শুধু মুখের দাবীতে, মিছিল করে, দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে ও পোষ্টারিং করে তথাকখিত আশেক হওয়া গেলেও প্রকৃত আশেক হওয়া যাবেনা। প্রকৃত আশেক হতে হলে রাসুল (স.)ও তাঁর আদর্শ কে এবং তাঁর আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কেরামসহ যাদের সাথে তাঁর ভালোবাসা ছিল তাদেরকে সব কিছুর চেয়ে এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসতে হবে। তাহলেই রাসুল (সা.) এর প্রকৃত আশেক হওয়ার মাধ্যমে পরকালে তাঁর দীদার, শাফায়াত ও হাউজে কাওছারের শরবত নছীব হবে এবং চিরস্থায়ী শান্তির ঠিকানা জান্নাতের মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন হবে, ইনশা আল্লাহ। 
        হে আল্লাহ! আমাদেরকে রাসুল (স.) এর খাঁটি প্রেমিক হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।        
   

 


প্রসঙ্গ: প্রবন্ধ মন্তব্য: 0


আপনার মন্তব্য লিখুন


Graveter Image

নাম

April 12