বিস্তারিত

সাদাকাতুল-ফিতর ও যাকাত

মাওলানা মুফতী আব্দুল আহাদ 29 এপ্রিল

সাদাকাতুল-ফিতর ও যাকাতের আহকাম

রোযাদার যেন তার  রোযাকে বেহুদা ও অশ্লীল কথা বার্তা ও গর্হিত আচরণ থেকে পবিত্র করতে পারেন এবং  ঈদের আনন্দে ধনীদের সাথে গরীব-দুখীরাও যেন শরীক হতে পারে- এ মহান দুইটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সদাকাতুল-ফিতর ওয়াজীব করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদাকাতুল-ফিতরকে ওয়াজিব করেছেন-রোযাকে বেহুদা ও অশ্লীল কথাবার্তা জনিত অপরাধ থেকে ও গর্হিত আচরণ থেকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে এবং মিসকিনদের খাদ্যের সুব্যবস্থার জন্যে। যে ব্যক্তি  ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করবে,তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের পরে তা আদায় করবে, তার জন্য তা একটি সাধারণ দান হিসাবে গণ্য হবে ।

 আবু দাউদ শরীফ ।

সদাকাতুল-ফিতর মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত,যা রমযানুল মুবারকের শেষে ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করতে হয়। মুসলিম উম্মাহ এ আমলটিকে  নববী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক আমলের সাথে নিয়মিত আমল করে আসছে।ইহা আমাদের অঞ্চলে

 “ফিতরা” নামে পরিচিত। সদাকাতুল-ফিতর ও যাকাত কেবল তাদেরই   আদায়া করতে হবে যারা  নিসাব পরিমাণে মালের মালিক। নিম্নে নিসাবের আলোচনা তুলে ধরা হল।

কি পরিমাণ মাল হলে যাকাত দিতে হবে তা মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, আর এর নির্ধারিত পরিমাণকেই নিসাব বলে।

সোনার নিসাব হচ্ছে, বিশ মিছকাল ( সাড়ে সাত তোলা)। রুপার নিসাব হচ্ছে,দু’শ দিরহাম (সাড়ে বাহান্ন তোলা)।

অর্থাৎ,সাড়ে সাত তোলা সোনা ও সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা সমমূল্যের নগদ টাকা হচ্ছে “নিসাব” ।

এই নিসাব পরিমাণ সোনা বা রুপা অথবা সমমূল্যের নগদ টাকা,যে ব্যক্তির কাছে থাকবে তাকে সাহেবে নিসাব বা নিসাবের মালিক বলা হবে।

এই সাহেবে নিসাবের উপর যাকাত দেওয়া ফরজ করা হয়েছে।তিনি উক্ত সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত হিসাবে আল্লাহর নির্দেশিত পথে অবশ্যই খরচ করবেন।

? কাদের উপর যাকাত ও  সদাকাতুল-ফিতর ওয়াজিব

 

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ হচ্ছে স্বাধীন হওয়া,মুসলমান হওয়া,বালেগ তথা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া,আকেল বা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া,নিসাব গ্রাস করে নেয় এমন পরিমাণ ঋণ থেকে মুক্ত থাকা,নিসাব  পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া এবং উহার উপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া এবং ব্যবসায়ের মাল হওয়া।

ব্যবসার আসবাবপত্র ও অলংকারাদি যদি সোনা বা রূপার মূল্যের পরিমাণে হয় এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত হয় তাহলে এগুলোর উপরও যাকাত ফরজ।

যাকাতের নিসাব ও সদাকাতুল-ফিতরের নিসাব একই রকমের,তবে শুধু এতটুকু পার্থক্য যে যাকাতের নিসাবের উপর বছর অতিবাহিত হতে হয়,এবং ব্যবসার মাল হতে হয়;কিন্তু সদাকাতুল-ফিতর ক্ষেত্রে শুধু নিসাব পরিমাণে থাকলেই তার উপর ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব হয়ে যায়, চাই সে মাল ব্যবসার হোক বা নাহোক এবং তার  উপর বছর অতিবাহিত হোক বা না হোক।

১।ঈদুল-ফিতরের দিন ফজরের সময় আসার সাথে সাথে সদাকাতুল-ফিতর ওয়াজিব হয়। আর যার উপর সদাকাতু-ফিতর ওয়াজিব, তার মাল অবশ্যই ঋণ মুক্ত হতে হবে,এবং মৌলিক প্রয়োজন ও পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ হতে উদ্বৃত্ত হতে হবে।

২। নিত্য প্রয়োজন বলতে শুধু ততটুকু ধর্তব্য,যতটুকু হলে স্বাভাবিক ভাবে  জীবন চলে যায়;এক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রয়োজন ধর্তব্য নয়।যেমন থাকার ঘর, ঘরের আসবাব পত্র,কাপড়-চোপড়,বাহন, হতিয়ার এবং কর্মচারী ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অন্তর্ভুক্ত। বিধায় এ সব জিনিসের উপর যাকাত ও সদাকাতুল-ফিতর ওয়াজিব নয়।

৩। এক জন ব্যক্তি নিজের ও নিজের সম্পদহীণ শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে সদাকাতুল-ফিতর আদায় করবেন। আর যদি শিশু সন্তান সম্পদশালী হয় তাহলে তার সম্পদ থেকে আদায় করবেন।

 

৪। নিজ স্ত্রী ও প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পক্ষ হতে আদায় করা জরুরী নয়। যদিও তারা তার পরিবার ভুক্ত হয়

৫।এক বছরের খোরপোশের ব্যবস্থা হয়ে যায় এমন পরিমাণ জায়গা জমি বাদ দিয়ে,বাকি জায়গা জমির মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়,তাহলে তার উপর সদকাতুল-ফিতর ও কুরবানী ওয়াজিব।

৬। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিতাবাদী বা বই-পুস্তক, পোষাক, বড় বড় ডেগ, উন্নতমানের বিছানা ও চাদর, গদী, শামিয়ানা ইত্যাদির মূল্য যদি নিসাব পর্যন্ত পৌছে তাহলে তার উপর সদাকাতুল-ফিতর ওয়াজিব।

৭। রেডিও, টেলিভিশন, জরুরী আসবাব নয়, তাই সেগুলোর দাম নিসাবের মধ্যে গণ্য হবে।কমপিউটার যদি শুধু বিনোদনের জন্যে না হয়ে বরং প্রয়োজনীয় তথ্য জানা ও জীবিকা অর্জনের সহায়ক হয় তবে তার উপর যাকাত ও সদকাতল-ফিতর ওয়াজিব নয়।

৮। সদকাতুল-ফিতর ঈদের দিন সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার সাথে সাথে ওয়াজিব হয়। সুতরাং সুবহে সাদিকের পূর্বে  কোন ব্যক্তি মারা গেলে অথবা সুবহে সাদিকের পর কোন শিশু জন্ম নিলে বা কেই ইসলাম গ্রহণ করলে তার উপর সদকাতুল-ফিতর ওয়াজিব নয়।

৯। ঈদের দিন ঈদগাহে যাবার পূর্বে সদাকাতুল-ফিতর আদায় করা সুন্নত। তবে ঈদের দু’একদিন পূর্বে আদায় করতে চাইলে তা জায়েয আছে। কোন কারণে যদি ঈদের দিন দিতে না পারে তা হলে পরে আদায় করতে পারবে।

১০। কারণ বশত যদি কেউ রমযানে রোযা না রাখে তাহলে তার উপর সদাকাতুল-ফিতর ওয়াজিব।

১১। কোন ব্যক্তি চাইলে এক ফকীরকে তার সম্পূর্ণ ফিতরা দিয়ে দিতে পারে। আবার ভিন্ন ভিন্ন ফকীরকেও দিতে পারে।

১২। যাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েয আছে, তাদেরকে ফিতরা দেওয়াও জায়ের। আর যাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই তাদেরকে ফিতরা দেওয়াও জায়েয নেই।

সদকাতুল-ফিতর কি দ্বারা আদায় করবেন।

জানা আবশ্যক যে, সাদাকাতুল-ফিতর আদায় করার জন্য শরীয়ত মোট পাঁচটি খাদ্য বস্তু নির্ধারণ করেছে। যথা-

১।গম

২।যব

৩। খেজুর

৪।কিসমিস

৫।পনির ।

খেজুর, পনির, কিসমিস ও যবের ক্ষেত্রে তাকে এক সা অথবা তার মূল্য আদায় করতে হবে। আর গমের ক্ষেত্রে অর্ধ সা অথবা তার মূল্য দিলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে, দামের দিক দিয়ে  উল্লেখিত খাদ্যদ্রব্যগুলো সমান নয় বরং কোনটার দাম অনেক বেশী আবার কোনটার কম। কেউ যদি সবচেয়ে  কম দামেরটা দিয়ে সদাকতুল-ফিতর আদায় করতে চায় তা হলে তার  সদাকাতুল-ফিতর আদায় হয়ে যাবে। তবে নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী বেশী মূল্যের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সদাকাতুল-ফিতর আদায় করা উত্তম। কেননা যে যত বেশী মূল্যের খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদাকাতুল-ফিতর আদায় করবে, সে ততবেশী সওয়াবের ভাগী হবে। যেহেতু সহীহ হাদীসে গমকেও সদকাতুল-ফিতর আদায়ের একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে, যার পরিমাণ হচ্ছে অর্ধ সা, তাই কেউ যদি অর্ধ সা গম বা উহার মূল্য অথবা অর্ধ সা আটা বা তার মূল্য দান করে দেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তার সদাকাতুল-ফিতর আদায় হয়ে যাবে।

বর্তমান বাজারে গমের দামই যেহেতু সবচেয়ে কম, তাই ‘ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রতি বছর অর্ধ -সা- গমকে সদাকতু-ফিতরের সর্বনিম্ন পরিমাপ হিসাবে নির্ধারণ করে থাকে। আর অর্ধ সা গম বা আটার টাকার অংকটা নির্ধারণ করা হয় ঐ বছরের বাজার দর হিসাবে।

সর্বসাধারণের সুবিধার্থে আর্ধ‘সা’ গম/আটা/তার মূল্য দিয়ে ফিতরা প্রদানের প্রচলিত নিয়মটি একথা বুঝায় না যে, শুধুমাত্র এজিনিস দিয়েই সদাকাতুল-ফিতর আদায় করতে হবে।বরং বিত্তশালীদের  একটি বিষয়ে মনোনিবেশ করা দরকার যে, শরীয়ত যে  সমস্ত খাদ্যবস্তুকে সদাকাতুল-ফিতর আদয়ের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে ,সেগুলোর মধ্যে থেকে কোনটি দ্বারা আদায় করলে গরীব-দুখীদের সর্বত্তোম খেদমত হয় সে দিকে তারা বিশেষ লক্ষ রাখবেন।

কারণ, শরীয়তে সদাকাতুল-ফিতর বিধিবদ্ধ হওয়ার যে হিকমতের দিকে হাদীস শরীফে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘গরীব-দুখীদের খেদমত করা’। তাই উল্লেখিত বস্তু সমূহের মধ্য থেকে কোনটির মূল্য নির্ধারণ করলে  গরীব-দুখীদের মৌলিক প্রয়োজন অধিক পরিমাণে পূরণ হয় এবং তারা দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যখেয়ে মহান আল্লাহ পাকের শুকর আদায় করতে পারে,সেদিকে বিত্তশীলদের লক্ষ থাকা উচিৎ ।

আধুনিক পরিমাপের আলোকে সা / অর্ধ  সা

১সা = ৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়)।

অর্থাৎ ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশী।

তবে গরীবদের প্রতি লক্ষ্য করে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম দেওয়াই উত্তম।

অর্ধ  সা = ১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম (প্রায়)।

আর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশী।

তবে গরীবদের প্রতি লক্ষ্য করে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম দেওয়াই উত্তম।

যে সমস্ত খাদ্যবস্তু দ্বারা সদাকাতুল-ফিতর আদায় করা যায়।

১.গম অর্ধ  সা ) =  ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম )

২.যব ১সা ) =  ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

৩.খেজুর ১সা) =  ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

৪.কিসমিস ১সা ) =  ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

৫.পনির ১সা ) =  ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

দ্রষ্টব্য: যে ব্যক্তি যে শহরে অবস্থান করেন, তিনি সে  শহরের বাজার দর অনুযায়ী সাদাকাতুল-ফিতর আদায় করবেন

যাদের কাছে শুধু সোনা (বিশ মিছকাল = সাড়ে সাত তোলা)  আথবা শুধু রুপা(দু দিরহাম=  সাড়ে বাহান্ন তোলা) নাইকিন্তু কিছু সোনা, কিছু রুপা এবং নগদ টাকা ও ব্যবসার আসবাবপত্র রয়েছে তারা যাকাতের নিসাব নির্ণয় করবেন নিম্নরূপে

( শুধু সোনার মূল্য (যদি তা সাড়ে সাত তোলা পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী  হয়  *

শুধু রুপার মূল্য (যদি তা সাড়ে বাহান্ন তোলা পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী হয়  *

(  সোনার মূল্য + রুপার মূল্য (যদি নগদ অর্থ ও ব্যবসাপণ্য না থাকে *

(  সোনার মূল্য + নগদ টাকা । (যদি রুপা ও ব্যবসাপণ্য না থাকে *

(   সোনার মূল্য + ব্যবসাপণ্যের মূল্য।( যদি তার কাছে রুপা বা নগদ টাকা না থাকে*

(  সোনার মূল্য + রুপার মূল্য + নগদ টাকা + ব্যবসাপণ্যের মূল্য ।(যখন এ সবের প্রত্যেকটি তার কাছে কিছু কিছু করে থাকবে *

(রুপার মূল্য + নগদ টাকা। (যখন সোনা ও ব্যবসাপণ্য না থাকবে  *

( রুপার মূল্য + ব্যবসাপণ্যের মূল্য। (যখন সোনা ও নগদ টাকা না থাকবে  *

( রুপার মূল্য +  কিছু নগদ টাকা + কিছু ব্যবসাপণ্যের মূল্য।( যখন তার কাছে সোনা না থাকবে *

( ব্যবসার আসবাবের সাথে নগদ টাকা যোগ করবে ( যখন তার কাছে সোনা ও রুপা না থাকবে  *

( শুধু নগদ টাকা ( যার পরিমাণ সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বাহান্ন তোলা রুপার সমান হবে বা তার চেয়ে বেশী হবে    *

(শুধু ব্যবসাপণ্য (যার মূল্য সাড়ে সাত তোলা সোনা, বা সাড়ে বাহান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমান হয় বা তার চেয়ে বেশী হয়    *

হে আল্লাহ! আমাদের আমল করার তাওফীক দান করুন ।

 


প্রসঙ্গ: প্রবন্ধ মন্তব্য: 0


আপনার মন্তব্য লিখুন


Graveter Image

নাম

April 12